শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৯ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম:
তালেবানদের আফগান বিজয় ও মুসলমানদের স্পেন বিজয়

তালেবানদের আফগান বিজয় ও মুসলমানদের স্পেন বিজয়

মোঃ জাহিদুর রহমানঃ

দীর্ঘ বিশ বছরের যুদ্ধ শেষে সম্প্রতি তালেবানরা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল বিজয় করতে সক্ষম হয়েছে। গত ১৫ আগস্ট রবিবার আফগান প্রেসিডেন্ট
আশরাফ গনি তালেবানদের আক্রমণ প্রতিরোধ না করে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেছেন। ফলে তালেবানরা বিনাবাঁধায় রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করে রাজপ্রাসাদ
দখলে নিয়েছে। চলছে সরকার গঠন ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে আমেরিকা, বৃটেন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ আফগানিস্তান থেকে তাঁদের
কূটনৈতিক ও নাগরিকদের নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়া শুরু করেছে। আফগান নাগরিকেরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছাড়ছে, এমনকি রানওয়েতে চলন্ত প্লেনে
উঠে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করে জীবন দিতে দেখা গেছে অনেককেই। আফগান নারীরা জীবন-সম্ভ্রম নিয়ে শংকায় আছেন। তালেবানদের হাতে বন্দি হয়েছেন আফগান নারী
গভর্নর সালিমা মাজারি। এখনো পর্যন্ত পূর্বের তালেবান শাসনের ন্যায় নিরাপত্তাহীনতার তেমন কর্মকা- লক্ষ্য করা না গেলেও আফগান নাগরিকেরা তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারছেনা। যদিও সিনিয়র তালেবান নেতারা নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। শরীয়া আইন মেনে নারীরা সকল প্রকার কাজ করতে পারবেন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। গণমাধ্যমগুলো তাদের কাজ করতে পারবেন বলে তালেবান নেতৃবৃন্দ আশ্বাস দিয়েছেন। ঘোষণা করা হয়েছে সাধারণ ক্ষমা। কিন্তু তারপরও আশংকার কমতি নেই দেশের জনগনের।
তালেবান নেতারা আফগানিস্তানকে ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তান বানাতে চাচ্ছেন। কিন্তু ইসলামিক আমিরাতের নাগরিকদের জীবন-সম্ভ্রম ও সম্পদের
নিরাপত্তার অভাব থাকার কথা নয়। শরীয়া আইনে সকল পর্যায়ের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকার কথা বলা আছে। মুসলিম বিজয়গুলা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে- বিজিত ভূখ-ের নাগরিকদের নিরাপত্তার কখনও শংকা দেখা যায়নি বরং নাগরিকদের সকল প্রকার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা সুদৃঢ় হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মুসলমানদের স্পেন বিজয় ও পরবর্তীতে স্পেন ও স্পেনের জনসাধারণের অধিকার কতটা সুদৃঢ় হয়েছিল তার কিছুটা উল্লেখ করা যেতে পারে।
৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসা বিন নুসায়ের এবং তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে এক ঐতিহাসিক অভিযানে মুসলমানরা স্পেন জয় করে। ৮ম শতক থেকে শুরু করে প্রায়
আটশো বছর মুসলমানদের শাসন স্পেনকে সভ্যতা ও সংস্কৃতির উচ্চাসনে উন্নীত করেছিলো। ফলে মধ্য যুগীয় ইউরোপের অগ্রযাত্রায় স্পেনই পথ প্রদর্শকের
ভূমিকা পালন করেছিলো। মুসলমানদের আগমনের পূর্বে স্পেন গথিক রাজাদের অধীনে প্রায় ৩০০ বছর ছিল।
তখন স্পেনের জনসাধারণের কোনও কল্যাণ হয়নি বরং তারা ছিল নানা সমস্যায় জর্জরিত। শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচারে ভূমিদাস, ক্রীতদাস, বর্গাদার ও ইহুদীদের
মধ্যে করুন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা এক শোচনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। তৎকালীন গোথিক রাজা রডারিক আদেশ জারি করেছিলেন যে- ইহুদীগণ হয় খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবে, নতুবা স্পেন ত্যাগ করবে অথবা তাদের হত্যা করা হবে। জানা যায় ওই সময় প্রায়
নব্বই হাজার ইহুদী খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী প্রাদেশিক গভর্নরদের পুত্র-কন্যাদের রাজ প্রাসাদে জিম্মি রাখা হতো যেন কোনো গভর্নর বিদ্রোহ করতে না পারে। অবশ্য একথাও
প্রচলন ছিলো যে তাদেরকে রাজকীয় আদব-কায়দা, আচারসমূহ শিক্ষা দেয়ার জন্য রাজপ্রাসাদে রাখা হতো। সিউটার গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ানের কন্যা ফ্লোরিন্ডাও
রডারিকের রাজপ্রাসাদে ছিলেন। জুলিয়ান কন্যা ফ্লোরিন্ডা এক পর্যায়ে রডারিকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করলে কাউন্ট জুলিয়ান অপমান বোধ করেন। গোথিক শাসন থেকে মুসলিম শাসন শ্রেয় বিবেচনা করে জুলিয়ান নিজ অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্নর মুসা বিন নুসায়েরকে স্পেন আক্রমণের আহ্বান জানান। স্পেনের এক নাজুক ও ভয়াবহ অবস্থায় উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের শাসনামলে স্পেনের বিরুদ্ধে মুসলিম অভিযান পরিচালিত হয়। মাত্র ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে মুসলমান সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসায়ের অতি সহজেই স্পেন জয়
করেন। স্পেন জয়ের পরে আত্মকলহে অতিষ্ঠ, যুদ্ধ ও বিবাদ-বিসম্বাদে জর্জরিত স্পেনের সাধারণ মানুষ তাদের নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের হুমকি মনে করেনি
বরং তাঁরা মুসলমানদেরকে তাঁদের ত্রাণকর্তা ও হিতাকাঙ্খী হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
মুসলমানরাও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। এসময় তিনশত খ্রিস্টান ভূস্বামীকে তাঁদের জমিদারী ফিরিয়ে দিয়েছিল। ইসলামি জীবন ব্যবস্থা চালু হওয়ায় জনগণ দাস প্রথা থেকে অব্যাহতি লাভ করে এবং সাথে সাথে সামন্ত প্রথার নাগপাশ থেকে তারা মুক্তি পায় এবং কৃষকদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুয়েভী, গথ, ভ্যান্ডাল, রোমান এবং ইহুদী সকলের জন্যই সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়। কঠোর ও নির্যাতনমূলক ভিজিগথিক আইন-কানুন বাতিল করা হয়, যার ফলে ইহুদিগণ বিশেষভাবে উপকৃত হয়; এমনকি তারা সরকারি চাকুরীর সুযোগ লাভ করে। স্পেনও ইউরোপের শিক্ষা সংস্কৃতির জ্যোতিকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
মুসলমানদের প্রতিটি বিজয় অভিযানই এমন ইতিহাস তৈরি করেছে। গাজী সালাউদ্দিন আয়ুবীর জেরুজালেম বিজয়, অটোমান সুলতান মুহাম্মদ বা দ্বিতীয় মেহমুদের
কনস্টান্টিনোপল বিজয়, উমাইয়া, আব্বাসীয় খলিফাদের বিজয়সমূহ এবং পরবর্তীতে ভারতবর্ষের মুসলিম বিজয়সমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- কোনো মুসলিম বিজয় বিজিত এলাকার জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ছিলনা। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর অসংখ্য বিজয় বিশ্বের বিজেতাদের আদর্শিক শিক্ষা গ্রহণের অন্যতম দলিল। পরিশেষে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শিক বিজয়ের ইতিহাস -সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর মক্কা বিজয়ের ইতিহাস। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে বিনা বাধায় মক্কা বিজয়ের পরে মহানবী (সঃ) যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, নিকৃষ্টতম শত্রুদের নির্দিধায় ক্ষমা করে পবিত্র মক্কা নগরীতে শান্তি সৌহার্দ্য স্থাপন করেছিলেন যার
দ্বিতীয় ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব নয়। হাজার বছরের মুসলমানদের বিজয় অভিযান এবং বিজয়ের পরে বিজিত এলাকার শান্তি স্থাপন, এলাকাসমুহকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও সমৃদ্ধির চরম শিখরে পৌছে দেয়ার ইতিহাস।

আফগানিস্তানে তালেবান নেতৃবৃন্দ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মডারেট তালেবানের কথা বললেও তারা বাড়ি বাড়ি তল্লাসি চালাচ্চেন, একাধিক বিনোদন পার্কে আগুন
ধরিয়ে দিয়েছেন, তালেবান হুমকিতে দেশ ছেড়েছেন আফগান পপ তারকা আরিয়া। আমেরিকান নাগরিকদের তালেবানেরা মারপিট করেছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে আফগানিস্তানে সকল পর্যায়ের মানুষই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছে। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের পতাকা নিয়ে আফগান নাগরিকেরা কয়েক জায়গায় তালেবান বিরোধী বিক্ষোভ করেছে। তালেবানরা তাদের পূর্বের শাসনের তুলনায় বর্তমানে মডারেট শাসন উপহার দেওয়ার চিন্তা না করলে আফগানিস্তানে নিরাপত্তার এ
শঙ্কা থেকেই যাবে বলে মনে হয়। মুসলমানদের বিজয় কখনও জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারেনা, লুটপাট ও ধ্বংসের রাজত্ব কায়েম করতে
পারেনা।
# জাহিদুর রহমান, প্রচার সম্পাদক, মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ, গোপালগঞ্জ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..




© All rights reserved 2018 Banglarnayan
Design & Developed BY ThemesBazar.Com