বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৪ অপরাহ্ন
নাজমুল হাসান রাজ
৮ হাজার ৮৫০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যায়ে ‘সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে শতশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক তুষার মোহন সাধু খাঁ।
তথ্য বলছে, ক্ষমতা হারানো সাবেক আওয়ামী সরকারের সাবেক মন্ত্রী-সচিবদের সঙ্গে এসব
অনিয়ম-দুর্নীতি করে হাতিয়ে নেয়া টাকার ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন। সারাদেশ থেকে প্রকল্পবাস্তবায়নকারী সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে এসব টাকা সংগ্রহ করেছেন প্রকল্পের স্টিমেটর আনোয়ার সিকদার।
একদিকে সাধু খাঁ’র সমস্ত অপকর্মের স্বাক্ষি অন্যদিকে হাতিয়ে নেওয়া এসব টাকার একটা বড় অংশের ভাগিদারও তিনি বলেও জানা যায়।
প্রকল্পের খুটিনাটির সমস্তই আনোয়ার সিকদারের মুখস্ত। প্রকল্পের কোন কোন খাত থেকে কী উপায়ে সরকারের টাকা নিজেদের পকেটে ঢুকানো যায় সাধু খা’কে সেই পথও দেখিয়েছেন তিনি।
মাঠপর্যায়ে ঠিকাদারদের সাথে দেন-দরবারসহ কমিশনের সমস্ত টাকা সংগ্রহ করার দায়িত্বও ছিলো আনোয়ার সিকদারের। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের ৩ জন ঠিকাদার এবং ৪ জন কর্মকর্তা এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন।
তুষার মোহন সাধু খাঁ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর পদ বাগিয়ে নেয়ার আগে তিনি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা) পদে ছিলেন এবং সমগ্র বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন।
গেল বছর ৩১ অক্টোবর তুষার মোহন সাধু খাঁ‘র বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ করে একটি আবেদন জমা পড়ে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে। এই আবেদনটি করেন শামিম হোসেন নামের এক ব্যাক্তি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সমগ্র বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন তিনি ওই আবেদনে।
স্বেচ্ছাচারিতা ও নিম্নমানের কাজের মধ্যদিয়ে প্রকল্পের শত-শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এসব টাকা লুটপাটের কারণেতদন্তপূর্বক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয় ওই চিঠিতে।
অভিযোগসূত্রে জানা যায়, তুষার মোহন সাধু খাঁ রাজধানীর লালমাটিয়ায় তার ছোট বোনের বাসায় ঘুষের টাকা রাখতেন।
পরে ঠিকাদার দিলীপ বাবুর মাধ্যমে হুণ্ডি করেওই টাকা ইন্ডিয়া এবং আমেরিকায় বসবাস করা তার ছোট ভাই ও কানাডায় বসবাসরত তার মেয়ের কাছে পাঠাতেন।
ঘুষের টাকার বোশিরভাগ তার ছোট বোন ও ভাইয়ের কাছেও পাঠান বলেও উল্লেখ করা হয় এই চিঠিতে। ছোট ভগ্নিপতি মারা যাওয়ার আগে তিনিই হুল্ডি ব্যবসায়ির কাছে ঘুষের টাকা পৌঁছে দিতেন। ইন্ডিয়া, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই ও শ্রীলঙ্কায় তার নামে বেনামে গাড়ি-বাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
সমগ্র বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের প্রাকলনিক আনোয়ার সিকদারের মাধ্যমে আগে ঘুষের টাকা লেনদেন করলেও পরে সরাসরি নিজেই বিশ^স্ত ঠিকাদার ও বিভিন্নজেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর মাধ্যমে ঘুষের টাকা লেনদেন করেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী নিজ মন্ত্রণালয় হয়ে পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প রিভাইসড হওয়ার কথা থাকলেও বিধি লঙ্ঘণ করে এবং নিয়মের বাইরে ব্যত্যয় ঘটিয়ে আগের আইটেমের সঙ্গে নতুন আইটেম একসঙ্গেযোগ করে প্রকল্প রিভাইসড করা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সমগ্র বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ডিপিপির উপজেলা অনুযায়ী বন্টননামা ১৫০ থেকে ১৫ হাজার পর্যন্ত টিউবওয়েল স্থাপনের জন্য বরাদ্দ প্রদান করা আছে। শুধু একটি জেলায় ১৫ হাজার টিউবওয়েল স্থাপনের কথা রয়েছে ডিপিপিতে। বেশিরভাগ উপজেলায় ৪ হাজার, ৫ হাজার, ৬ হাজার, ৭ হাজার পর্যন্ত টিউবওয়েল বরাদ্দ রয়েছে।
ডিপিপিতে যে উপজেলায় পূর্বের প্রকল্পের বেশি কাজ হয়েছে এবং অন্য প্রজেক্ট চলমান আছে সেই উপজেলায় কম বরাদ্দদেয়া হয়েছে।
যে উপজেলায় পূর্বের প্রকল্পে কম কাজ হয়েছে এবং অন্য প্রজেক্টের চলমান কোনো কাজ নাই সেই উপজেলায় বেশি বরাদ্দদেয়া হয়েছে।
এছাড়া, জনসংখ্যার আনুপাতিক হার হিসেবে ডিপিপির রিভাইজড ছাড়াই কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে দেশের সব ইউনিয়নে সমভাবে বন্টন করা হয়েছে। যেখানে অতীব জরুরি সেখানে বরাদ্দ না দিয়ে যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে টিউবওয়েল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
ডিপিপি অনুযায়ী প্রতি ৬০ জনে ১টি টিউবওয়েল স্থাপন হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের কোনো কোনো জায়গায় ২০ জনে একটি করে টিউবওয়েল পেয়েছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় একটিও নেই। ফলে অবহেলিত এলাকা অবহেলিতই রয়ে গেছে।
এ হিসাবে সারাদেশে প্রায় ৬ লাখ টিউবওয়েল স্থাপন করা হলেও জনগণ সার্বিকভাবে উপকৃত হবে না। ৬ লাখ টেন্ডার আহ্বান শেষ করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক নিজে লাভবান হওয়ার উদ্দেশে সমভাবে টেন্ডার আহ্বান করেছে। ডিপিপিতে যেভাবে প্যাকেজ উল্লেখ ছিল তা ভায়লেট করা হয়েছে। এবং মনগড়াভাবে করা হয়েছে। ডিপিপির সাথে সংখ্যা ও প্যাকেজের কোনো মিল নাই।
১০ শতাংশ লেস কাজের সিএসও মাসের পর মাস পড়ে থাকার প্রমাণ পাওযা গেছে। জেলার বিভিন্ন মাঠ পর্র্যায়ের টেন্ডার প্রত্রিয়া যাচাই করে এর সত্যতা পাওয়া যায়। পিডি নিজে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশে এসব অনিয়ম করা হয়েছে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে ফিল্ডে সময়মত কাজও বাস্তবায়ন হয়নি।
পানির কোয়ালিটি নিয়ে পিডিসহ কর্মকর্তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। টিউবওয়েলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ও আয়রন থাকার পরও ঠিকাদারদের বিল দেয়া হয়েছে। যেখানে ওয়াটার কোয়ালিটি খারাপ সেখানে ১০ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ভেসেল টাইপ প্রেসার ফিল্টার ধরা আছে ডিপিপিতে। কিন্তু পিডি তার পূর্ব পরিচিত ও নিজস্ব কোম্পানির নিম্নমানের ১৮ হাজার টাকার ‘আরও ফিল্টার’ ওই সমস্ত খারাপ ওয়াটার কোয়ালিটির জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
ডিপিপিতে পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই ৪৯১টি উপজেলায় ছিল। বেশিরভাগ জেলায় কোনো অগ্রগতি নাই। শুধু টেন্ডার আহ্বান করা হলেও নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় জনগণ উপকৃত হচ্ছে না। প্রকল্পটির কাজে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে খোদ সরকারি সংস্থা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ণ বিভাগ (আইএমইডি)। এরমধ্যে নির্মাণ ত্রুটি ঠিকাদারের জবাবদিহীতা নিশ্চিত না করার মতো অভিযোগও রয়েছে তুষার মোহন সাধু খাঁ’র বিরুদ্ধে।
প্রকল্প পরিচালনার অন্যতম নিয়ামক হওয়া সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সংখ্যক পিআইসি ও পিএসসি সভা না করা, মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ না দেয়ার মতো দুর্বলতা ও ত্রুটি রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় এই অভিযোগে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পিডি তুষার মোহন সাধু খা গ্রেড-৩ পাওয়ার আগে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) মিটিংয়ে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আনোয়ারুল ইসলাম তার পদোন্নতিতে বিরোধিতা করেছিলেন।গোয়েন্দা রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় তাকে গ্রেড-৩ না দেওয়ার জন্য এসএসবি মিটিংয়ে উপস্থিত সদস্যদের অবহিত করেন।
পরে তিনি জনস্বাস্থ্যের ৩২ পৌরসভার পিডি ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা জনাব নজরুল ইসলাম মিয়ার মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (আইইবি) সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জনাব খাইরুল ইসলামকে ৩ কোটি টাকা দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্যপদ নেন।
এছাড়া ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের মাধ্যমেও তার বিষয়ে ব্যাপক তদবির করা হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর এপিএস জাহিদের মাধ্যমে মন্ত্রীকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা হয়।স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পদোন্নতির বিষয়টি সরাসরি না বলে তুষার মোহন সাধুকে আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ সদস্য ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা হিসেবে গ্রেড-৩ দেওয়ার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান। তিনি পরে তুষার মোহন সাধুকে গ্রেড-৩ দেওয়ার জন্য সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে নির্দেশ দেন।
এভাবে তিনি গ্রেড-৩ বাগিয়ে নেন।
প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার যোগ্য হিসেবে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর গ্রেড-৩ এর স্থায়ী পদের কর্মকর্তা হতে হবে। যে কারণে সাধু খাঁ’র এই দৌড়-ঝাপ।
অভিযোগের বিষয় মন্তব্য জানতে তুষার মোহন সাধু খা’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে দেখা করেন নি। কয়েকবার মুঠোফোনে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেন নি।