শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১০ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম:
আমার দেখা একজন জনপ্রিয় মানবিক নেতা

আমার দেখা একজন জনপ্রিয় মানবিক নেতা

মোঃ শহীদুল ইসলাম বেলায়েত

নেতা, নেতৃত্ব এবং মানবিকতা তিনটি বিশেষণ ভিন্ন ভিন্ন হলেও একই সূত্রে গাঁথা। একটিকে বাদ দিলে অপর দুটি সার শূন্য হয়ে যায়। ঘষে মেজে নিজের নামকে নেতাদের কাতারে উঠাতে পারলেও, নেতৃত্ব দেয়ার মতো শক্তি অনেকেই অর্জন করতে পারেন না। ফলে সেই নেতা স্বল্পকালের মধ্যেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়েন, চলে যান মানুষের অন্তরের আড়ালে। নেতৃত্ব দানে সক্ষম নেতার অবর্তমানে সমাজ বা রাষ্ট্র তার শূণ্যতাকে অনুভব করে দীর্ঘদিন। আর নেতৃত্ব দানে সক্ষম নেতা যদি মানবিক গুন সম্পন্ন হন তবে তাকে মানুষ স্মরণ রাখে যুগযুগ ধরে। এমনই একজন মানবিক গুন সম্পন্ন নেতৃত্বদানকারী নেতার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপস্থাপনের জন্য আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস।

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলাধীন গোপীনাথপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মিয়া পরিবারের মরহুম আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার জৈষ্ঠ্য পূত্র খায়রুল বাকি মিয়া ছিলেন এমনই একজন মানবিক গুন সম্পন্ন নেতা। ২০০৭ ইন্তেকালের প্রায় দেড়যুগ পেরিয়ে গেলেও সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে তাঁর স্মৃতি এখনও সমুজ্জল। ১৯৪৭ সালে তার জন্ম। শিক্ষা জীবন যখন শেষ হয়, তখন গোপীনাথপুরের মিয়া পরিবারে নেতৃত্ব দেয়ার মতো তেমন যোগ্য কেউ ছিলনা। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও তিনি চাকুরীতে যোগদান না করে তিনি সমাজ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার দিপ্ত পদচারণায় গোপিনাথপুরবাসি দীর্ঘদিন পরে যেন প্রান ফিরে পায়।
শূন্যহাতে মানুষের সেবা করা যায় যৎসামান্য, বিষয়টি অনুধাবন করে তিনি খুব অল্প বয়েসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রভাবশালী এক প্রতিদ্বন্দিকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ইউনিয়ন পরিষদের গন্ডি খুবই ছোট বিধায় সমগ্র উপজেলার মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সুখ দুঃখের কথা শুনে তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা করার সুযোগ খুবই কম। এমন ভাবনা থেকে তিনি ১৯৭৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দিতা করে জয়ের মালা ছিনিয়ে আনেন। ১৯৭৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮২ থানা উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালে মুকসুদপুর উপজেলা পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এসময়েই তার মানবিক গুনের প্রকাশ পায় সারা উপজেলার গন্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায়।
মানুষের প্রতি তার অন্তরিকতায় কোন প্রভেদ ছিলনা। একজন নিঃস্ব মানুষও তার কাছে ছিল সম্মানিত। তার বাড়িতে কেউ কোন প্রয়োজনে গেলে শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সাথে তার সমস্যার কথা শুনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। তার বাড়ি থেকে কোন মানুষ মুখে কিছু না দিয়ে ফিরে আসতে পারতোনা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাড়ীর উনুন জ্বলতো। আগত মানুষদের তিনি নিজ হাতে আপ্যায়ন করতে বেশী পছন্দ করতেন। অর্থের টানাপোড়ন সত্বেও কারো কাছে কোনদিন প্রকাশ করেননি। প্রয়োজনে পৈত্রিক সম্পদ খুইয়েছেন।
প্রতি বছর এস,এস,সি ও এইচ,এস,সি পরীক্ষায় তার বাড়িতে মানুষের ঢল নামতো। এসব পরীক্ষার্থীদের থাকার জন্য দুটি ঘর ছিল। তাদের থাকার জন্য ঘরের মধ্যে ছিল সারিবদ্ধভাবে সাজানো বড়বড় চৌকি। দেখলে মনে হতো কোন সেনা ছাউনির ব্যারাক। নিয়মিত তিন বেলা খাবার দেয়া হতো নির্দিষ্ট সময়ে। সকালের নাস্তা, বেলা উাঠার আগেই তৈরী হতো, যাতে পরীক্ষার্থীরা খেয়ে যথা সময়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে পারে। ছাত্রীদের জন্য ছিল বাড়ীর মধ্যে পৃথক ঘর। অভিভাবক যারা থাকতো তারাও মেহমান হিসাবে বিবেচিত হতেন। মাসাধিককাল চলতো ছাত্রদের এই মিলন মেলা।
কেউ কোন বিপদে পড়লে সংবাদ পেয়ে ছুটে যেতেন সেখানে। কোথাও কোন বিবাদ হলে তাৎক্ষনিক সেখানে ছুটে গিয়ে তা নিরসন করে দিতেন। কোন কারনে কেউ থানায় আটক হলে রাত যতো গভীরই হোক ছুটে গিয়ে ছাড়িয়ে এনে বিবাদ মিমাংসা করে দিতেন। সালিশ বৈঠকে বসে উপস্থিত এলাকার সকল মানুষের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা সিদ্ধান্ত দিতেন। কোন দুস্থ মানুষ সাহায্যের জন্য তাঁর কাছে গেলে শূন্য হাতে ফিরে আসেনি।
তার সাথে আমার শেষ দেখা হয় ২০০৭ সালের ২৬ জানুয়ারী সন্ধ্যায়, রাজৈর থানার এক সালিশী থেকে ফেরার সময়। সদাহাস্য মানুষটার মুখটা কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। জানতে চাইলাম শরীর কেমন। শরীরটা ভালনা বলে চলে গেলেন। সন্ধ্যা সাতটার একটু পরেই জানতে পারলাম মিয়াভাই নামে খ্যাত বাকি ভাই সকলের মায়া ত্যাগ করে চির বিদায় নিয়েছেন। ছুটে গেলাম তার বাড়িতে, হাজার হাজার মানুষ ছুটে এসেছে তাকে শেষবারের জন্য একবার দেখতে। পরেরদিন সকালে তার যানাজার নামাজে নামে মানুষের ঢল। এসময় কয়েক হাজার ভিন্ন ধর্মের মানুষ ঘিরে রাখে নামাজের মাঠ। এমন একজন মানব দরদী মানুষ মুকসুদপুরবাসী আর পাবে কিনা জানিনা। পরম করুনাময়ের কাছে প্রার্থনা তিনি যেন তাকে পরপারে শান্তিতে রাখেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..




© All rights reserved 2018 Banglarnayan
Design & Developed BY ThemesBazar.Com