মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২১ অপরাহ্ন
আমার সাংবাদিক বন্ধু শাহীন ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলো। ওর ডিপার্টমেন্ট ছিলো কলা ভবনের নীচ তলায় আর আমার তৃতীয় তলায়। কিন্তু একই এলাকার ছেলে হিসেবে আমার সাথে তার প্রচন্ড সখ্যতা ছিলো। আবার ফিলোসোফি বিষয়ের সাবসিডিয়ারী ক্লাশে সপ্তাহে ৩/৪ দিন দেখা হতো, লাইব্রেরীতেও আমাদের দেখা হতো। শাহীন তার ভাইয়ের বাসা থেকে ক্লাসে আসতো তাই একটা ক্লাস শেষ করে অন্য ক্লাসের মধ্যবর্তী সময়ে লাইব্রেরীতে কাটাতো। নিজের কাজ ছাড়াও
আমি মঝে মধ্যে ওর সাথে দেখা করার জন্য লাইব্রেরীতে যেতাম। সেখানে দেখতাম সে শুধু একাডেমিক লেখাপড়াই করতোনা, ওর ভাবনা থেকে নানা বিষয়ে আর্টিকেল লিখতো। প্রথম দিকে আমি ঠাট্টা করতাম। কারণ লেখাগুলো ও বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠালেও তা ছাপা হতোনা। হঠাৎ একদিন লাইব্রেরীতে ওর সামনে ৩/৪টা কাগজ দেখলাম। শাহিন সেদিন খুব উৎফুল্ল। বসেই দেখলাম ” সাপ্তাহিক গণমত” নামে অপরিচিত একটা পত্রিকার কয়েক কপি।
শাহীন অত্যন্ত আনন্দের সাথে আমাকে দেখালো- ” প্রেমিক নজরুলের কবরে এ প্রেমিক কারা” শিরোনামে তার লেখা ছাপা হয়েছে। আমি পড়লাম, অনেক ভালো লাগলো বন্ধুর লেখা ছাপার অক্ষরে দেখে।
আমার মধ্যেও অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করেছিলো সেদিন। মনে হচ্ছিল আমি ও যদি লিখতে পারতাম।
এরপর থেকে শাহীনের লেখার প্রতি আগ্রহ বহুগুণে বেড়ে গেল।
শাহীন বিভিন্ন পত্রিকার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে থাকলো। যতোদুর মনেপড়ে ছাত্রাবস্থায় দৈনিক জনতা সহ আরও দু’একটা পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতো এবং লেখাপড়া শেষ করে দৈনিক ইনকিলাবের সাব এডিটর হিসেবে যোগদান করার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে ও গ্রহণ করে আজও টিকে আছে।
সত্যিই চমৎকার লেখনীর ক্ষমতা শাহিনের, বিশেষ কতে বাংলা বানানগুলোর প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলো সে। আমি যতটুকু বাংলা বানান রপ্ত করতে পেরেছি, এর পিছনে শাহীনের অবদান কিঞ্চিৎ হলে আছে। আমি শাহীনকে দেখেছি ইতিহাসের ছাত্র হয়ে বানান গুলো, যতি চিহ্নের ব্যবহার, স,শ এবং ষ এর ব্যবহার, সাধু চলিত ভাষার মিশ্রণ হলো কিনা, বাক্য অসামঞ্জস্য অথবা অসমাপ্ত থাকলো কিনা- কতো সাবধানতার সাথে নির্ভুল করে লিখতে চেষ্টা করতো। বিভিন্ন প্রকার তথ্য সংগ্রহ করার জন্য কতো বইপত্র, পুরাতন সংবাদপত্র ঘাটাঘাটি করতো। তার এ জ্ঞান চর্চা এবং পরিশ্রম দেখে লেখার জন্য আগ্রহ থাকলেও সাহস হলোনা।
একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় একই ধরনের বিষয়ের ছাত্র হয়ে ওর মতো লিখতে না পারার জন্য আফসোস হতো। তাই সে সময় থেকেই আমি ওকে আলাদাভাবে সম্মান করতাম। সাংবাদিকদের প্রতি আমার আলাদা শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ জাগ্রত হওয়ার জন্য শাহীন আমার জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়।
শাহিনের প্রতিবেদনে কবি নজরুলের কবর তখন প্রেমিক মুক্ত হয়েছিলো কিনা মনে পড়েনা, তবে আমার আর এক বড় ভাই “মেয়েদের হাফ টিকেটে সিনেমা দেখানো হচ্ছে ” চিরকুটে এমন নিউজ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিলে পত্রিকাটি সে নিউজ ছেপে দেয়। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় সিনেমা হলটি। কতো পাওয়ার সাংবাদিকদের কলমে। এমন পাওয়ারের অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে।
অনিয়ম, দূর্নীতি, অনাচারের বিরুদ্ধে বারুদ বিহীন কলম নামক অস্ত্র দ্বারা অতি সহজেই রুখে দাড়াতে পারেন তারা। তারা রুখে দাড়ান, তারা সমাজ ও রাস্ট্র ব্যবস্থার দুর্বল জায়গা গুলো চিহ্নিত করে সমাজ মেরামতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বিধায় তাদেরকে জাতির বিবেক বলা হয়ে থাকে। প্রতিটি পেশার মানুষ তাদের সম্মান করে, অনেক ক্ষেত্রে সমীহ ও করে।
অন্য যে কোনো পেশার মানুষের জন্য সাংবাদিকদের ফেস করা একটা জটিল কাজ। হেড মাস্টার সাহেবের সামনে যেভাবে সাবধানে কথা বলতে হয়, সাংবাদিকদের সামনে নাকি তার থেকে ও বেশি সাবধানে কথা বলতে হয়। একবার ভুল কিছু বলে ফেললে রক্ষা নেই।
অনেক নেতাকে দেখি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে নিজের বক্তব্য পেশ করে তড়িঘড়ি করে চলে যান, সাংবাদিকদের ফেস করতে চাননা।
বিসিএস এর ভাইভায় উত্তীর্ণ অনেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের ও দেখি কিভাবে তারা সাংবাদিকদের ফেস করে ঘন ঘন থ্যাংক ইউ দিয়ে দ্রুত লীভ নেয়ার চেষ্টা করেন। একারণে কোন রাজনৈতিক নেতা, পদস্থ কর্মকর্তা অথবা ব্যবসায়ী যদি সাংবাদিকদের স্মার্টলী মোকাবেলা করতে পারেন, সেটা তার আলাদা যোগ্যতা হিসেবেই বিবেচিত হয়।
সাংবাদিকতা পেশার সম্মানের কথা বলছিলাম। আমি সাংবাদিকতা বিষয়ে কোনো পড়াশোনা করিনি, সাংবাদিকতা ও করিনি। তবে সংবাদপত্র পড়ি, সংবাদ দেখি, বিভিন্ন আর্টিকেল পড়তে কবিতা উপান্যাসে চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিলো আমার। আর তাই সাংবাদিকদের প্রতি এক বিশেষ সম্মান আমার মধ্যে বিরাজমান।
যতোটুকু বুঝতে পেরেছি – এ পেশা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি পেশা।
একজন সাংবাদিককে সাহসী হতে হয়, পরিশ্রমী হতে হয়, জ্ঞানী হতে হয় এবং আপোষহীন হতে হয় । তাদেরকে প্রয়োজনে প্রশাসন ও পাওয়ারের বিরুদ্ধে কলম ধরতে হয়, সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের পক্ষে তাদের কলম চালাতে হয়, কলম চালাতে হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে। হাওয়া বুঝে কলম চালিয়ে আদর্শ সাংবাদিক হওয়া যায়না; এমনকি প্রয়োজনে কলম না চালিয়ে নীরব থেকেও আদর্শ সাংবাদিক হওয়া যায়না।
ইদানীং শুনছি সাংবাদিকদের নাকি প্রকারভেদ আছে।
সরব সাংবাদিক, নীরব সাংবাদিক, হলুদ সাংবাদিক, একচোখা সাংবাদিক,আপোষকামী সাংবাদিক, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সাংবাদিক, এমনকি পবিত্র কাবা শরীফের ইমামদের মানব বন্ধনে দাড় করানো সাংবাদিক ইত্যাদি। এ প্রকার গুলো অবশ্য সাংবাদিকতার বইয়ে লেখা থাকার কথা নয়, এগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি। কোন প্রকারের সাংবাদিকের সংজ্ঞা কি তা জানার বড় আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে সাংবাদিকতার এথিকস সম্পর্কে আরও একটু পড়াশুনা করার। এ শেষ বয়সে এসে তা হয়তো সম্ভব হবে না। জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচিত এ মহান পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তবর্গ যদি নীতির জায়গা থেকে তাদের কাজ করে যান তাহলে রাস্ট্র নীতি , রাজনীতি, এবং সমাজ নীতি সমস্ত জায়গা পজিটিভলী বদলে দেয়ার ক্ষেত্রে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে করি। সমাজ থেকে দূর্ণীতি শেষ করতে না পারলেও অন্তত আরও মিনিমাইজ করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু পক্ষপাত দুষ্ট অথবা দূর্ণীতি পরায়ণ আপোষকামী একজন সাংবাদিক কখনো এগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারেন না, সে নৈতিক মনোবল তার থাকেনা।
দেশ ও জাতির প্রয়োজনে জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচিত আদর্শ সাংবাদিকগণ সর্বদা সোচ্চার থাকবেন এবং জনগণের মনের কথা ফুটে উঠবে তাদের কলমের আচড়ে- সে প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
লেখকঃ শিক্ষক ও প্রচার সম্পাদক, মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ।