সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৬ অপরাহ্ন

শিক্ষক হিসেবে আত্ম-সমালোচনাঃ জাহিদ রহমান

শিক্ষক হিসেবে আত্ম-সমালোচনাঃ জাহিদ রহমান

সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠাননের একজন সহকারী অধ্যাপকের সাথে সাম্প্রতিক বিষয়াবলি নিয়ে কথা হচ্ছিল। উক্ত ব্যক্তি এবং আমি সমপদে, সম-স্কেলে একই বছর বেসরকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি।
উক্ত শিক্ষক নি:সন্দেহে আওয়ামী পরিবারের সন্তান। কিন্তু বর্তমানে তার সাথে কথা বলে মনে হলো তিনি বর্তমান সরকারের উপর খুবই বিরক্ত। আর সম্প্রতি কোটা আন্দোলন ও পরবর্তী বিষয়াবলী সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তার এ বিরক্তি তিনি আমার কাছে অকপটে এবং আবেগের সাথে দ্বিধাহীন ভাবে প্রকাশ করেছেন। এমনকি তিনি সরকারকে অযোগ্য সরকার হিসেবে আখ্যা দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। আমি বিস্ময়ের সাথে সরকারের প্রতি তার অসন্তোষের কারণগুলো শুনতে ছিলাম।

তিনি বললেন- আমি সহকারী অধ্যাপক হয়ে ১০০০/- বাড়ি ভাড়া, ৫০০/- টাকা চিকিৎসা ভাতা আর ২৫% উৎসব ভাতা পাই। এই ২৫% উৎসব ভাতা পেয়ে চাকরি জীবন প্রায় শেষ। আমাদের থেকে নিম্ন পদের শিক্ষকগণ তাদের উৎসব ভাতা দিয়ে উৎসবে পোল্ট্রি মুরগীও কিনতে পারেনা। দেশ উন্নত হলেও শিক্ষকদের জীবনযাত্রার উন্নয়নে সরকার কিছুই করছেনা। প্রতিটি শিক্ষকের জীবন আজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তারপরও ছাত্রদের উপর সরকার নির্যাতন চালাচ্ছে। এটা মেনে নেয়া যায়না। আমি তাকে আমার মতো করে সান্ত্বনা দিলাম।
এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। যদিও আমি জানি আমার এ বক্তব্য আমাদের অনেক শিক্ষক-ভাই বোন খুব ভালোভাবে নিবেন না। আমি জানি অনেকের গালমন্দ আমাকে শুনতে হবে।

ছাত্রদের প্রতি নির্যাতন হলে তা কোনো শিক্ষকই মেনে নিতে পারেননা, আমিও না। কিন্তু ছাত্রদের দাবি আদায়ের আন্দোলনকে তারা দেশ ধ্বংসকারিদের হাতে তুলে দিলে, তারা দেশকে শশ্মানে পরিণত করতে চাইলে সেখানেও কোনো শিক্ষকের সমর্থন কাম্য হতে পারেনা।

৮০ দশক বা ৯০ দশকের গোড়ার দিকে আমাদের শিক্ষকগণ ৩’শ থেকে ৭’শ টাকা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন, আর সে বেতন হাতে পেতেন কয়েকমাস পর। আমার ধারণা ওই সময় আমাদের শিক্ষকগণ বেতন বা টাকার দিকে না তাকিয়ে মর্যাদার দিকে তাকিয়ে এ পেশাকে বেছে নিয়েছেন। ছাত্রছাত্রী,অভিবাকদের সম্মান ও ভালবাসায় এ পেশাটি তাঁদের নেশায় পরিণত হয়েছিল। শিক্ষকদের বৈশিষ্ট্য হলো Simple Living, high thinking. তাঁদের জীবনযাত্রা হবে সাদাসিধে আর চিন্তাধারা হবে আকাশচুম্বী।
সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর পাদটীকা প্রবন্ধে ইংরেজ লাট সাহেবের তিন ঠ্যাং ওয়ালা কুকুরের মাসিক খরচের সাথে পঁচিশ টাকা মাইনে পাওয়া পন্ডিত মশাইয়ের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন পন্ডিত মশাইয়ের আট সদস্যের সংসারের মাসিক খরচ পঁচিশ টাকা, যা লাট সাহেবের কুকুরের এক ঠ্যাং এর মাসিক খরচের সমান।
অর্থাৎ এখানে কোনোকালেই অর্থনৈতিক সুবিধা বেশি ছিলনা।
তারপরও সরকার শিক্ষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষায় ধাপে ধাপে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। একজন শিক্ষক হিসেবে আমিও দ্বিধাহীন ভাবে
বলতে চাই – এখনও বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য যা করা হয়েছে তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়।

তারপরও আমার সহকর্মী বন্ধুর ন্যায় যদি বলি সরকার কিছুই করেনি, তাহলে সত্য বলা হবেনা। অনেকেই একথা বলে থাকেন যে- বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন স্কেলের ২৫% উঠসব ভাতা বিএনপি জামাত জোট সরকার দিয়েছেন। কিন্তু কেন যেন এটা আমরা স্বীকার করিনা যে – বেতনের শতভাগ পর্যন্ত উন্নয়ন, পে-স্কেল এর আওতাভুক্ত করা, ২০% বৈশাখী ভাতা, সরকারি চাকুরীজীবীদের ন্যায় প্রতি বছর ৫% ইনক্রিমেন্ট, গত বছর থেকে ৫% প্রণোদনা, চিকিৎসা ভাতা ২৫০/- থেকে ৫০০/- এবং বাড়ি ভাড়া ৫০০/- থেকে ১০০০/- টাকা এগুলো আওয়ামী লীগ সরকারই দিয়েছে। এছাড়াও শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কম্পিউটার ল্যাব, হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্তকরণ, সকল পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে পদসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি আওয়ামী লীগ সরকার করেছে।
আমার সহকর্মী শিক্ষক বন্ধুকে আমি পরিশেষে বলেছিলাম – ২০০৪ সালে ৪৩০০/- টাকা স্কেলে চাকরিতে যোগদান করে ৪২০০/- বেতন ড্র করেছিলাম, আর আজ তার প্রায় দশগুণ বেতন ড্র করি যা পুরাটাই ওয়ান ইলেভেনের সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হয়েছে। তারপরও বলবো সরকার কিছু করেনি, তা কি সত্যকে অস্বীকার করা হবেনা! তারপরও বলবো বিএনপি সরকার ২৫% উৎসব ভাতা দিয়েছে, আর কেউ কিছু দেয়নি! আমরা শিক্ষকরা হিসাবে এতোটা কাঁচা, নাকি সত্য স্বীকার করতে চাইনা। তবে বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা এবং উৎসব ভাতা বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারের অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তা না হলে বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় শিক্ষকদের জীবনের কঠিন বাস্তবতায় আওয়ামী পরিবারের সন্তান হয়েও আওয়ামী লীগ সরকারকে অযোগ্য বিবেচনা করার মতো শিক্ষকের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
আর শিক্ষক সমাজ আওয়ামী লীগ বিরোধী মানসিকতা নিয়ে নতুন প্রজন্মকে ক্রমান্বয়ে আওয়ামী বিরোধী প্রজন্ম তৈরি করবে। যার কিছু নিদর্শন কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
আমার বন্ধুবর শিক্ষকের বড়ই আক্ষেপ সমস্ত চাকরি জীবন ২৫% উৎসব ভাতা পেয়ে কাটিয়ে গেলেন! অথচ বেতন যে কখন প্রায় দশগুণ হয়েছে একবারও চিন্তা করে দেখেননি!

বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ হতে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে- অতীতের তুলনায় উন্নত সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক, অভিভাবক থাকার পরও সাধারন মানুষের জীবন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করার মানসিকতা সম্পন্ন শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারলাম না কেন? কেন আমাদের মেধাবীদের যৌক্তিক আন্দোলন ধ্বংসযজ্ঞের রুপ নিল আর কেনইবা দাবি আদায় হবার পরও রাজপথ রঞ্জিত হলো! রাষ্ট্রের সকল ভালো-মন্দের দায় অবশ্যই সরকারের রয়েছে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আমরাও কি এ দায় এড়াতে পারি! নিজেদেরকে গর্বের সাথে রাজাকার বলে শ্লোগান দেয়ার মানসিকতা সম্পন্ন, দেশপ্রেম হীন মেধাবী নতুন প্রজন্ম তৈরি হলে শিক্ষক সমাজের সে দায় এড়ানোর পথ নেই বলে মনে করি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..




© All rights reserved 2024 Banglarnayan
Design & Developed BY ThemesBazar.Com