শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১০:৩৯ অপরাহ্ন

দাকোপে দেড় লাখ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিরাপদ আশ্রয় খুজে পাবে না

দাকোপে দেড় লাখ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিরাপদ আশ্রয় খুজে পাবে না

জিএম, আজম, দাকোপ (খুলনা):
খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়,জলোচ্ছ্াসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবে না প্রায় দেড় লাখ মানুষ। প্রায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার মানুষের জন্য এ উপজেলায় কমপক্ষে ২০০ টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ উপজেলায় ৩ টি পোল্ডারে বর্তমানে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্াসে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র (সাইক্লোন সেল্টার) সরকারী-বেসরকারী ভাবে রয়েছে মাত্র ১১৮ টি। দাকোপ উপজেলার ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর আলোকে বিভিন্ন গবেশনা সুত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে,বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় দাকোপ উপজেলা তিনটি পোল্ডারে বিভক্ত। ৩১ নং, ৩২ নং, ও ৩৩ নং এই তিন পোল্ডারে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করেন। জন সংখ্যার অনুপাতে সাইক্লোন সেন্টার স্থাপন অদ্যবদি পর্যাপ্ত না হওয়ায় ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর খুলনার উপকূলীয় দাকোপের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় হারিকেন ও তার জলোচ্ছ্াসে সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়নে ৮৫ জন মানুষের প্রাণহানী ঘটে, চালনা পৌরসভার ৪, ৫, ও ৬ নং ওয়ার্ডের প্রায় সব ঘর বাড়ি দুমড়ে-মুচড়ে মাটির সাথে মিসে গিয়েছিল।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলংয়কারী ঘূর্ণিঝড় সিডরে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ১৯ জন মানুষের প্রাণহানী ঘটে সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলংয়কারী ঘূর্ণিঝড় আইলার তান্ডবে লন্ডভন্ড হয় উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন সহ চালনা পৌরসভার জনপথ ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় হাজার হাজার কাঁচাপাকা ঘরবাড়ী। ২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণীঝড় ফণী এবং ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল,এবং ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পান জলোচ্ছাস সহ আঘাত হানে। এতে কোনো মানুষের প্রানহানী না হলেও ঘর বাড়ি ও গাছ পালার ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল।

আইলার জলোচ্ছ্াসের কারণে ওই সময় ১৩ জন মানুষের প্রাণহানী ঘটে। অনেকে বসত ভিটা ঘরবাড়ী সহয় সম্বল বানের জলে হারিয়ে চলে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। আইলার জলোচ্ছ্াসে এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও চালনা পৌর সভা সহ বিশেষ করে কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়নের অসহয় মানুষ দীর্ঘ প্রায় দুই বছর ধরে নদীর লবণাক্ত পানির সাথে লড়াই করে ও খোলা আকাশের নিচে ওয়াপদা বেড়ীবাধের উপর মানবেতর জীবন যাপন করে আসছিলো। অবহেলিত এ উপজেলার অসহয় বিপন্ন মানুষদের রক্ষার্থে সরকারী বেসরকারী ভাবে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা যতসামান্ন।

বিশেষ করে এ উপজেলার চালনা পৌরসভার প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ সহ কামারখোলা, সুতারখালী, বানিশান্তা ও তিলডাংঙ্গা বাজুয়া ইউনিয়ন সহ প্রায় দেড় লাখ মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। এ সকল স্থানে পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওসব মানুষ খোলা আকাশের নিচে অথবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত বেঁড়িবাধের উপর মানবেতর আশ্রয় গ্রহন করতে হবে।

এ উপজেলায় কর্মরত ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি) সহকারী পরিচালক মোঃ আলমগীর হোসেন এবং অফিস সহকারী আশরাফুল আলম জানান, দাকোপ উপজেলার জনসংখ্যার অনুপাতে বর্তমানে যে আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় তা পর্যাপ্ত নয়। কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রের ৫০ জন থেকে ২ হাজার জন ধারন ক্ষমতা থাকায় এর বেশি লোকজন সেখানে যেতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ওই সব স্থানে বেশি লোক ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন সাইকেøান সেল্টার তৈরী করা পয়োজন।

কোন কোন কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৮ শত মানুষ আশ্রয় নিলেও সে হিসাবে এখানে কমপক্ষে আরো ৭০/৮০টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা প্রয়োজন। সেই সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকায় গবাদিপশুর আশ্রয়ের জন্য অন্তত ২০টি মাটির কিল্লা নির্মাণ করাও প্রয়োজন। তারা বলেন কিছু এলাকায় জরুরী ভিত্তিতে এসব আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ জরুরী। তা না হলে বড় ধরণের দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। বর্তমানে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্াস সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্ব মুহূর্তে জনগণকে সচেতন করতে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি) এর অধীনে এ উপজেলার চালনা পৌরসভা সহ ৯ টি ইউনিয়নের বিভিন্ন ইউনিটে পুরুষ মহিলা মিলে ১৮ শত জন সেচ্ছাসেবী কাজ করে চলেছেন। বিধি মোতাবেক তিন বছর পর পর সেচ্ছাসেবক পুঃনর গঠন করা হয় এবং কাজ চলে ১২ মাস।

উপকূলীয় এলাকার সুতারখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মাসুম আলী ফকির জানান, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তার ইউনিয়নের মানুষ সর্বশান্ত। এ ইউনিয়নের জনসংখ্যার তুলনায় আশ্রয় কেন্দ্র আছে মাত্র ২৪ টি দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হলে এ ইউনিয়নে জরুরী ভিত্তিতে কমপক্ষে আরো ১৮/২০ টি সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা প্রয়োজন। কামারখোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পঞ্চানন মন্ডল বলেন এ ইউনিয়নে বর্তমানে ১৭ টি সাইক্লোন সেল্টার আছে। আমার ইউনিয়নের মানুষ একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগে সর্বশান্ত হয়ে গেছে। আরো ১০/১৫ টি সাইক্লোন সেল্টার তৈরীকরা পয়োজন।

চালনা পৌরসভার মেয়র সনত কুমার বিশ্বাস বলেন পৌরসভাটি একেবারে পশুর নদির মোহনায় অবস্থিত হওয়ায় যে কোনো ঝড়-ঝঞ্জা ও জলোচ্ছাস হলেই চালনা পৌরসভায় সর্ব প্রথম আঘাত করে। সে তুলনায় বাজারের ভিতরে নদীর কাছাকাছি স্থানে এবং পৌরসভার ঘনবসতিতে আরো ৩/৪ টি সাইক্লোন সেল্টার তৈরী করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের কাছে চালনা পৌরসভার সকল বাসিন্দাদের পক্ষে আমি জোর দাবী জানাই।

এ রকম ভাবে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা জানান, সুতারখালী ইউনিয়নে, কামারখোলা ইউনিয়নে, পানখালী ইউনিয়নে, তিলডাংঙ্গা ইউনিয়নে, বানিশান্তা ইউনিয়নে ও চালনা পৌরসভায় সাইক্লোন সেন্টার জরুরী ভিত্তিতে নির্মাণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে এ উপজেলায় চালনা পৌরসভা সহ ৯ টি ইউনিয়নে মোট ১১৮ টি সাইক্লোন সেল্টার রয়েছে। এর মধ্যে চালনা পৌর সভায় মাত্র ৫ টি, পানখালী ইউনিয়নে ১৩ টি, দাকোপ ইউনিয়নে ৫ টি, লাউডোব ইউনিয়নে ৯ টি , কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নে ১০ টি, সুতারখালী ইউনিয়নে ২৪ টি, কামারখোলা ইউনিয়নে ১৭ টি, তিলডাঙ্গা ইউনিয়নে ১১ টি, বাজুয়া ইউনিয়নে ১৩ টি, বাণীশান্তা ইউনিয়নে ১১ টি সাইক্লোন সেন্টার রয়েছে।

উপজেলা প্রোকৌশলী (এজিইডি) ইঞ্জিনিয়ার ননী গোপাল দাস বলেন, সুন্দরবন ঘেঁষা ও বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় এ দাকোপ উপজেলার জনসংখ্যার তুলনায় যে সাইক্লোন সেন্টার বা আশ্রয় কেন্দ্র আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যার কারণে এ অঞ্চলের অনেক অসহয় মানুষ দুর্যোগের সময় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আশ্রয় নিতে পারে না। আপাতত নুতন কোন সাইক্লোন সেল্টার করার নির্দেশনা নেই। জনসংখ্যার তুলনায় আরো বেশী সাইক্লোন সেল্টার নির্মান করা প্রয়োজন। বর্তমানে এ উপজেলায় স্কুলকাম সাইক্লোন সেল্টার এবং সাইক্লোন সেল্টার রয়েছে মোট ১১৮ টি। এর মধ্যে এলজিইডি কতৃক ৮১ টি, বেসরকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ কর্তৃক ৮ টি, ফায়েল খায়ের ৬ ািট, কারিতাস ৬ টি, সিএসএস ১ টি, এসইএস ১ টি, ত্রান মন্ত্রনালয় ৫ টি, পিইডিপি(২) ৩ টি, শিক্ষা প্রকৌশলী ১ টি, র্জামান ১ টি, রুপান্তর ১ টি, ওপেক ১ টি, ডিএসকে ১ টি, ইসিআরআরপি ১ টি সহ আরো কয়েকটি সরকারী-বেসরকারী সংস্থা মিলে এ অঞ্চলে ১১৮ টি সাইক্লোন নির্মান করেছে।

দাকোপ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুনসুর আলী খান জানান, তার উপজেলায় সিডর ও আইলার তান্ডবে উপকূলীয় এলাকার মানুষের প্রানহানি সহ হাজার হাজার কাঁচাপাকা ঘরবাড়ী ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার মত এ উপজেলায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার নেই। আরো অনেক বেশি সাইক্লোন সেল্টার প্রয়োজন। এসব ব্যপারে আমি জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন মিটিংয়ে বক্তব্যের সময় তুলে ধরেছি।
দাকোপ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগের সভাপতি আলহাজ্ব শেখ আবুল হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় এ দাকোপ উপজেলার জনসংখ্যার তুলনায় যে সাইক্লোন সেন্টার বা আশ্রয় কেন্দ্র আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম রয়েছে। যার কারণে এ এলাকার মানুষ দুর্যোগের সময় ও পরে কোন উপায়ন্ত না পেয়ে তাদের পরিবার পরিজনদেন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। সমুদ্র উপকূলীয় এ উপজেলার অবস্থান হওয়ায় আইলা ও সিডরের সময়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সে অনুযায়ী এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হলে জরূরী ভিত্তিতে অন্তত ২৩০ টি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করা প্রয়োজন।

দাকোপ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল ওয়াদুদ এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ উপজেলায় আমি কর্মরত অবস্থায় ঘূর্ণী ঝড় ফণী, বুলবুল,ও আম্পান ঝড় মোকারেলা করতে যেয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে চালনা পৌরসভা সহ ৯ টি ইউনিয়নে আরো অনেক বেশি বেশি সাইক্লোন সেল্টার জরুরী ভিত্তিতে তৈরী করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..




© All rights reserved 2018 Banglarnayan
Design & Developed BY ThemesBazar.Com