বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৮ অপরাহ্ন
গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি:
চলতি বছরে ধানের দাম নেই হতাশায় কৃষকরা, ধান চাষে নয় বরং সবজি চাষে স্বাবলম্বী হয়েছেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের পুটিমারী গ্রামের কৃষক আমীর হোসেন । ৬ শতাংশ জমিতে সবজি চাষ করে কোটি টাকার উপরে সম্পদ ক্রয় করেছেন তিনি ।
সবজি চাষী ও বিক্রেতা থেকে জীবন শুরু করে নিজ প্রচেষ্টায় ভাগ্যের পরিবর্তনে শুণ্য থেকে কোটিপতি হওয়ার সফলতায় বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পাওয়ায় আমির হোসেনের বেড়ে যায় কাজের অনুপ্রেরনা। এখন সে তার বসতবাড়ির চার পাশে নিজ ও বর্গা নেয়া জমিসহ ১৬ বিঘা জমিতে বিভিন্ন সবজি চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে স্থানীয়দের । সবজিই নয় মালটা চাষেও ব্যপক সফলতার আলো ছড়াচ্ছেন তার বাগান থেকে । তিনি ফসল উৎপাদনে বাজারের কোন রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করেন না। এর পরিবর্তে তিনি নিজের তৈরী কীটনাশক এবং কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করে ।
আমির হোসেন যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, তখনই তার দিনমজুর পিতা মোজাহার ব্যাপারীর মৃত্যু হয়। ফলে অসহায় দরিদ্র পরিবারের সন্তান আমির হোসেন বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে প্রথমে একটি হোটেলের মেসিয়ারের কাজ নেন। কিন্তু তাতেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়না, পেটে জোটে না দু’বেলা দু’মুঠো আহার।
ধার-দেনা করে ৫ হাজার টাকা লোন নিয়ে ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে পৈতৃক সুত্রে পাওয়া ৫ শতক জমিতে ১০০টি পেঁপের চারা লাগান আমির হোসেন। ওই জমিতেই সাথি ফসল হিসেবে চাষ করেন আঁদা। ছয় থেকে সাত মাসের চেষ্টায় পেঁপে ও আঁদা বিক্রি করে তার আয় হয় ১৫ হাজার টাকা। এভাবে বছর খানেক পর সবজি বিক্রির টাকা জমিয়ে এক বিঘা জমি ক্রয় করেন । সেখানেও একই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন। অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধা খাটিয়ে চাষে সফল চাষি হিসেবে এভাবেই নিজকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। শুধু উৎপাদন নয় নিজ হাতেই আবার তার এই সবজি বিক্রয় করেন স্থানীয় হাট ভরতখালী বাজারে ।
প্রতি বছর খরচ বাদে তার আয় হয় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। আমির হোসেন জানান, বর্তমানে তিনি দুই বিঘা জমিতে পেঁপে ও সাথি ফসল হিসেবে হলুদ, কলা আড়াই বিঘা, হলুদ ও লেবু ১০ শতক, কচু ১৬ শতক, মরিচ ১৬ শতক, ধান ২ বিঘা, গেন্ডারি আঁখ ১৬ শতক, আদা ২ বিঘা, নেপিয়ার ঘাস ১০ শতক, ৬৩ শতকে কুমড়া ও সাথি ফসল শসা, ১০ শতকে ধনচে, ১৬ শতকে পটল, ও সাথি ফসল হিসেবে আদা চাষ করেছিলেন কিন্তু সর্ব নাশা গত বন্যায় তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে । এছাড়াও বৃদ্ধ বয়সের কখনো যদি কৃষি কাজ করতে সমস্যা হয় সে জন্যই তিনি ১ একর জমিতে চাষ করেছেন উন্নত জাতের মালটা সাথী ফসল হিসাবে মালটার বাগানে আছে মুখ কচু । তার জমিতে প্রতিদিন ২ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা শ্রমিক মাসিক সাড়ে ৭ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন । এছাড়া তিনি ৫০ শতক জমিতে বসতবাড়ী করে ঘরের চারপাশে তিনি বিভিন্ন জাতের ফল ও ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন।
আমির হোসেনের স্ত্রী করিমন বেগম একজন আদর্শ গৃহিনী। তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। সবার বড় ছেলে আয়নুর রহমান স্নাতক পাসের পর বর্তমানে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত। বড় মেয়ে লিপি বেগম এইচএসসি পর্যন্ত পড়ার পর বিয়ে হয়েছে।
ছোট মেয়ে আরাফা আক্তার এ বছর বগুড়ায় ¯œাতক সম্মানে অধ্যায়নরত। ছেলে মেয়েদের বড় করতে যে অর্থ প্রয়োজন হয়েছে তার সবজি বিক্রির টাকা থেকেই জোগার করতে হয়েছে । এছাড়াও তিনি ইরি-বোরো ও আমন ধান চাষ করে অধিক ফসল উৎপাদনেও সাফল্য অর্জন করেছেন। ফসল উৎপাদনে আমির প্রচলিত কীঁটনাশক ব্যবহার করেন না। এ জন্য তিনি বিভিন্ন গাছের রস মিসিয়ে নিজেই উদ্ভাবন করেছেন কীটনাশক। ১৫ লিটার পানিতে ১৫ ফোঁটা কেরোসিন তেল ও বিষকাঁটালি নামের এক প্রকার গাছের রস মিশিয়ে ক্ষেতে ¯েপ্র করে পোকা দমন করেন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি সফলও হয়েছেন। এছাড়া রাসায়নিক সারের পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেন কেঁচো, গরুর গোবর, কচুরি পানা, পরিত্যাক্ত জমিতে ধনচে চাষ করে বিশেষ কায়দায় এই ধনচের চারা জমিতে মিসিয়ে তা থেকে তৈরী করা হয় কম্পোস্ট ও জৈব সার।
সফলতার নানা কথা বর্ননা করতে গিয়ে আমির হোসেন আরো জানান, অধিক লাভের আশায় ধান চাষ করতে গিয়ে কৃষকরা দিন দিন পুজি হাড়াচ্ছে তাই প্রয়োজনের বেশী ধান চাষ নয় বরং সবজি চাষেই কৃষকরা দেখতে পারবে সফলতার মুখ ।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ধনারুহা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিম প্রতিবেদককে জানান, একটি জমিতে একসঙ্গে ৪ টি ফসল চাষের সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় কৃষক আমির হোসেনের ভাগ্যে মিলেছে বিভিন্ন পুরস্কার। কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন বাংলাদেশের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া বাংলাদেশ একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচার থেকে সম্মাননা ক্রেষ্ট এবং জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে বহু সনদ পেয়েছেন এই আমির হোসেন। তার কৃষি উৎপাদন চিন্তা আমাদের মুগ্ধ করেছে ।
মুক্তিনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরশাদ আজিজ রোকন জানান, কৃষক আমির হোসেন আমার ইউনিয়নের গর্ব । তার সাক্ষ্যাতকার নিতে বিভিন্ন গনমাধ্যম এই ইউনিয়নে আসায় এই ইউনিয়নটি ক্রমেই দেশে বিদেশে পরিচিত হয়েছে ।
সাঘাটা উপজেলা কৃষি অফিসার মবিনুজ্জামান জানান, নিয়মিত কৃষি বিভাগ থেকে আমির হোসেনকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া কৃষি বিভাগের বিভিন্ন সভা সমাবেশে দৃষ্টান্ত হিসেবে আমির হোসেনকে উপস্থিত করা হয় অন্যান্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ।
যাতে তাঁর এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে কৃষকরা তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে। এদিকে, কয়েকদিন পূর্বে আমির হোসেনের নার্সারীর লাগানো পেপে চারা মুক্তিনগর ইউনিয়নের গরিব অসহায় পরিবারের মাঝে উপজেলা চত্বর থেকে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন,উপ সহকারি কৃষি অফিসার আব্দুল মওলা,আসাদুজ্জামান সরকার,সত্তরজ্জন সরকার প্রমুখ।